সূর্যের তাপে যেন পুড়ে যাচ্ছে সব। বাতাসে যেন আগুনের হলকা। কংক্রিটের দেয়াল কিংবা ছাদ ফুঁড়েও তাপ ঢুকে পড়ছে শরীরে। না যায় ঘরে থাকা, না যায় বাইরে খোলা আকাশের নিচে পা ফেলা। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে তাই সকাল থেকেই মানুষ ছুটছেন কিছুটা শান্তির খোঁজে ছায়া-শীতল পরিবেশে। কিন্তু এই কংক্রিটের নগরীতে কতটুকুই বা আছে তেমন সবুজ শ্যামল শীতল ছায়াঘেরা প্রাঙ্গণ, যা আছে তার ভেতরেও নানা অজুহাতে বাড়ছে কংক্রিটের আয়তন। তবু নিরুপায় মানুষ ঘুরেফিরে ভিড় করেন রাজধানীর নামমাত্র কয়েকটি পার্কে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ফারহানা তাহের তিথি, রিনা আকতার তুলি, মেহেদী হাসান খাজা ও সাজ্জাদুল কবীর।
রমনা পার্ক
শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) ছুটির দিনে অনেকেই ভিড় করেন রমনা পার্কে। পার্কে ঢুকেই দেখা মেলে আজিমপুর থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা নজরুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাসায় প্রচণ্ড গরম, বাচ্চারা ছটফট করে। এ জন্য তাদের রমনা পার্কে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে আমিসহ আমার পরিবারের সবাই বাতাস উপভোগ করতে পেরে বেশ শান্তি পাচ্ছি।’
মগবাজার থেকে পার্কে আসা পুলিশ সদস্য রায়হান বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমার বন্ধের দিন। বাসায় বয়স্ক মা রয়েছেন, তিনি বাসায় থাকতে চান না। তা ছাড়া আমার ৯ বছরের একটি ছেলে ও ১৩ বছরের একটি মেয়ে আছে, তারা বলছিল কোনো একটা পার্কে যাবে। এ জন্য রমনা পার্কে নিয়ে এসেছি।’
গরমের মধ্যে বাসায় এসি না থাকায় প্রায় প্রতিদিন ছেলেমেয়েরা বাইরে যেতে চায়। বেশি সমস্যা করে ভিকারুননিসায় পড়ুয়া মেয়েটা এমনটা জানিয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. চঞ্চল বলেন, ‘গরমের মধ্যে যখন বাইরে থাকি তখন এতটাই পানির পিপাসা লাগে বলে বোঝাতে পারব না।’
পার্কে ঘুরতে আসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক আব্দুল বাকের বলেন, ‘এই গরমে পানিশূন্যতার কারণে ত্বক নিষ্প্রাণ ও বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। ত্বক শুষ্ক হওয়ার পাশাপাশি উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। বাচ্চারা একটু বাতাস চায়, এ জন্য পরিবার নিয়ে পার্কে এসেছি।’
রমনা পার্কের নিরাপত্তা ও পরিবেশ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে বেশ ভালো। পুলিশ, সচিব, ডাক্তার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আমার মতো পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। ৫-১০ বছর আগের সেই রমনা পার্ক নাই, অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’
রমনা পার্কে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার কমান্ডার মো. সোহাগ বলেন, গরমে মানুষের কথা চিন্তা করে ভোর ৫টার পর কয়েকটি গেট খুলে দেওয়া হয়। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত পার্ক বন্ধ রাখা হয়।
সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে রমনা পার্কে ছিনতাই হতো। হিজড়ারা মানুষকে ডিস্টার্ব করত। এখন আর এমন হয় না। কারণ ওই সময় রাত ১০টা বা ১১টা পর্যন্ত মানুষ থাকত। এখন ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ কমে গেছে। ২৪ ঘণ্টা এখানে আমাদের আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। কোনো মানুষ যদি অভিযোগ করে তার অভিযোগ আমলে নিয়েই আমরা কাজ করি। ৬ মাসেও আমার কাছে চুরি, ছিনতাই বা বড় কোনো ধরনের অপরাধের অভিযোগ আসেনি। তা ছাড়া আমাদের এখানে সব সময় তৎপর থাকতে হয়। কারণ এখানে বিকেলে এবং সন্ধ্যার পরে সচিব, পুলিশ, ডাক্তার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ঘুরতে আসেন।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘রমনা পার্কে নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার সদস্যরা থাকেন। এ ছাড়া আমাদের টহল পুলিশ সব সময় কাজ করে। গরমের মধ্যে যারা পার্কে আসছেন, তাদের নিরাপত্তায় থানা-পুলিশ কাজ করছে। সার্বিক বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’
ধানমন্ডি লেক
ষাটোর্ধ্ব জমির মোল্লার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ঢাকায় থাকেন বহু বছর। কখনো দিনমজুর, কখনো রিকশা চালানো আবার কখনো শরীরে না কুলালে দোকানের ছোটখাটো কাজ করেন তিনি। তবে এই গরমে যেন কোনোটাই করে উঠতে পারছেন না। তাই শরীর জুড়াতে এসেছেন ধানমন্ডি লেকে। জানালেন, এই গরমে একটু আরাম পেতে তিনি এই লেকেই দিনে দুবার গোসল করেন।
গতকাল সরেজমিনে ধানমন্ডি লেকে গিয়ে দেখা যায়, সকালে নিয়মিত ব্যাম করতে আসা মানুষ বাদে তেমন কোনো লোকজন নেই। আবার দুপুরের দিকে লোকজন যেন আরও কমে গেল। ছুটির দিনেও বিকেল ৪টা পর্যন্ত তেমন ভিড় ছিল না লেকে। তবে এরপর থেকে সেখানে আসতে শুরু করেন লোকজন। তাদের মধ্যে নাজনীন তামান্না এসেছেন তার ১২ বছরের মেয়ে ও তার বান্ধবীদের নিয়ে। তিনি জানান, স্কুল বন্ধ সঙ্গে তীব্র গরমে কোথাও বের হওয়া হয়নি। তাই আজ মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছেন তিনি। লেককে বেছে নিলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাইরে অনেক গরম থাকলেও দেখছি যেখানে গাছপালা বেশি সেখানে তুলনামূলক গরম কম।
অন্য সময় বেলা গড়াতেই মানুষের ভিড় বাড়লেও এখন দুপুর পর্যন্ত তেমন ভিড় হয় না বলে জানালেন এখানে দীর্ঘদিন ধরে লেবুর শরবত বিক্রেতা লাবলু। তিনি বলেন, ‘লেকে বেশি ভিড় থাকে ছাত্রছাত্রীদের। অনেকে আবার স্কুল থেকে বাচ্চাকে নিয়ে আসেন লেকে। কিন্তু এখন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় লেকে লোকজন কম আসছেন। তবে গরমের কারণে তার লেবুর শরবত আগের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।’ লেকের এক রেস্তোরাঁর খাবার পরিবেশক মাসুদ বলেন, ‘অন্য সময় বিকেলে লেকে অনেক ভিড় হতো। কিন্তু এখন কমে গেছে। এমনকি শুক্র-শনিবারেও লোকজনের আসা কমে গেছে।’
লেকের পরিবেশ ও নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাকর্মীরা টহল দেন পার্কে। তাদের মধ্যে একজন নারী নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘লেকের নিরাপত্তায় আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করলেও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টহল দিতে এখন আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ গরমে হাঁপিয়ে উঠছি।’ তবে লেকের নিরাপত্তাব্যবস্থা আগের চেয়ে ভালো বলে জানালেন তিনি।
চন্দ্রিমা উদ্যান
রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে লেকের পাড়ের গাছের নিচে বিশ্রাম করছিলেন দুজন দিনমজুর। কখনো মাটি কাটা, বাসাবাড়ির মালামাল টানা ও কুলির কাজ করে পেট চালান তারা। তবে তীব্র গরমে শরীর খুব একটা সায় দেয় না। তাই আগের মতো কাজ করতে পারছেন না তারা।
উদ্যানে স্কেটিং করছিল তানভীর নামের এক কিশোর। তানভীরের বাসা মোহাম্মদপুরে। ওই কিশোর খবরের কাগজকে বলে, তীব্র গরমে রাস্তায় স্কেটিং করা কঠিন। এখানে সবুজ-গাছপালা পরিবেশ থাকায় তুলনামূলক ঠাণ্ডা এবং স্কেটিং করতে ভালোই লাগে।
ছুটির দিনে হওয়া মেয়েকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে এসেছেন রাইমা নামের এক নারী। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যখনই এখানে আসি সন্ধ্যা ৭টার পর আর থাকি না। সন্ধ্যার পর এখানে যৌনকর্মীদের আনাগোনা বেশি।’ তাই বিব্রতবোধ করেন বলেও জানান ওই নারী।
আদাবর-৯-এ থাকা ব্যবসায়ী সরোয়ার্দী হোসেন বলেন, ‘সন্ধ্যার পর এক দিন বাসায় ফিরছিলাম। সংসদের এই সড়কে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ও যৌনকর্মীদের ভয় বেশি। তাই দিনের বেলা চলাচল করলেও রাতে এই সড়ক এড়িয়ে চলি।’
উদ্যানের নিরাপত্তার বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আহাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংসদের পাশের এই উদ্যানটি ভিআইপি এলাকার মধ্যে পড়েছে। এখানে টহল পুলিশ সব সময় দায়িত্ব পালন করে। এ ছাড়া গরমের কারণে উদ্যানে মানুষের আনাগোনা বাড়ায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে দেখা হচ্ছে।
সন্ধ্যার পর যৌনকর্মী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চলাচলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের অবাধ বা প্রকাশ্যে চলাচলের সুযোগ নেই। কারণ মাগরিবের আজানের পরেই উদ্যানের সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর দর্শনার্থীদের চলাচল নিষেধ। তবে এই এলাকায় ছিনতাই বা দর্শনার্থী বিড়ম্বনার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উত্তরা সেক্টর ৭ পার্ক
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিকেল ৪টায় পার্কের প্রবেশপথ যখন খুলে দেওয়া হয়, তখন লোকজনের উপস্থিতি ছিল কম। যারা এসেছেন তাদের বেশির ভাগকেই গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। তবে কিডস জোনের দোলনায় বাচ্চা-শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত। দোলনায় দোল খেতে খেতে আনন্দে মেতে ওঠে তারা। পরিবারের সদস্যরাও তাদের সঙ্গ দেন। ছোট বোন মাহিমাকে দোলনায় দোল দিচ্ছিলেন নাফিজ ইসলাম। টঙ্গী হোসেন মার্কেট এলাকা থেকে এসেছেন। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘টানা গরমে বাসা থেকে বের হওয়া হয়নি। এখন স্কুল বন্ধ। ছোট বোনটা ঘুরতে যাওয়ার জন্য বারবার আবদার করছিল। সে জন্য পরিবারের সবাই মিলে এখানে এসেছি। অনেক গাছ থাকায় পরিবেশটা ঠাণ্ডা।’
সূর্যের প্রখর তাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে পার্কে বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতি বাড়তে শুরু করে। অনেকে গোল চত্বরে বসে আড্ডা দেন। যুগলদের উপস্থিতিও ছিল। অনেকে আবার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে আসেন। বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছের ছায়ায় তারা বিশ্রাম নেন। মূল গেটে দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য। ৫ বছর বয়সী ইনায়াকে লাল বেনারসি শাড়ি পরিয়ে বিয়ের সাজ দিয়ে নিয়ে এসেছেন মা তাহমিনা আফরিন। পেশাদার চিত্রশিল্পী নিয়ে এসেছেন ছবি তোলার জন্য। তখন ছোট্ট ইনায়াকে দেখতে জড়ো হন আগত দর্শনার্থীরা। জানতে চাইলে ইনায়ার মা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি ছোট একটা অনলাইন বিজনেস করি। কিন্তু আমার মেয়েকে কনের সাজে দেখার শখ ছিল। সেটা পূরণ করতে আজকে এসেছি এই পার্কে। খুবই ভালো লাগছে।’ কয়েকজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরকেও ভিডিও ধারণ করতে দেখা যায়।
এই পার্কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জাকির ও আশরাফুল খবরের কাগজকে জানান, পার্কের সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। এখানে ভালো দিক হচ্ছে সন্ধ্যা ৭টার পর শুধু বয়স্করা প্রবেশ করতে পারেন। তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। এ কারণে বয়স্ক লোকজন ভালোভাবে হাঁটতে পারেন। তবে গরমের কারণে লোকজন কম আসছেন। বাসা থেকে কেউ প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না।