আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপি যে একমাত্র বড় রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতায় আসার জন্য তাদেরই একমাত্র সক্ষমতা রয়েছে- এ বিষয়টি নানাভাবে বোঝাতে চাইছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলটি একদিকে ধৈর্ষের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে জানান দেওয়ার মতো কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গত শুক্রবার ঢাকায় বড় শোডাউন করেছে দলটি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এটাই সবচেয়ে বড় কর্মসূচি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, রাজধানীর নয়াপল্টন থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩ ঘণ্টাব্যাপী এ শোভাযাত্রাটি প্রদক্ষিণ করে। এতে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো জনগণের সামনে আনতে, বিশেষ করে ৩১ দফা নিয়ে আগামী ১৪ নভেম্বর সেমিনার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। রাজধানীর একটি হোটেলে এই সেমিনার হবে। ৩১ দফার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, ‘নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা প্রভৃতি। ৩১ দফা বাস্তবায়নে জনমত গড়তে জেলা ও মহানগরে বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনা সভা করবে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা এখন এলাকায় এলাকায় যাচ্ছেন। আগামী দিনে বিএনপি কী করতে চায় এবং ৩১ দফা রূপরেখা জনগণের কাছে তুলে ধরছেন তারা।
তিনি বলেন, অতীতে আওয়ামী লীগের মতো বড় ধরনের ভুলত্রুটি বিএনপি করেনি। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ দেশের জনগণকে ভোট দিতে দেয়নি। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এখনো কাজ করছে। আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে স্বচ্ছ বিএনপিকে পাবে জনগণ। এ জন্যই শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে কী করবে, আগের ভুলত্রুটি সংশোধন করে কীভাবে এগোবে- এ বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে চায় বিএনপি। অর্থাৎ জনগণের মধ্যে তারা ইতিবাচক বার্তা দিতে চান। বিএনপি আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে জনসাধারণের উন্নয়নের লক্ষ্যেই কাজ করবে। ইতোপূর্বে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। সেই সময়ে ছোটখাটো অনেক বিষয়ে ভুলভ্রান্তি হয়েছে, তা এখন অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছেন নেতারা। ফলে সব ভুলত্রুটি দূর করে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগোনোর পক্ষে দলটি।
সূত্রমতে, দলের মধ্যে অতিরিক্ত দলবাজি, দুর্নীতি এবং ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করা সনাতন পদ্ধতি চালু রয়েছে- এখান থেকেও বেরিয়ে আসতে চায়। ইতোমধ্যে দখল ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ১ হাজার ১০০-এর বেশি নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের বার্তা গেছে- আগের মতো একই কাজ করা যাবে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যেসব দোষে সমালোচিত হয়েছে ওই ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখা বা থামাতে চায় হাইকমান্ড।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই দলের কোনো রকমের দুর্নাম হোক চাইছেন না। ইতোমধ্যে প্রভাবশালী নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। তাদের দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শোকজ করা হয়েছে। যাদের উত্তর সন্তোষজনক হয়নি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে অনিয়ম ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো কাজ করা যাবে না- এমন বার্তাও গেছে নেতা-কর্মীদের কাছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত তিন মাসে যে পরিমাণ বহিষ্কার ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তা বিএনপির ইতিহাসে ঘটেনি। আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন ছাত্ররা। কিন্তু বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলোর যে ভূমিকা রয়েছে তাও অস্বীকার করছেন না পর্যবেক্ষকরা।
অবশ্য তারা এও বলছেন, একটি দেশের মূল বিষয় হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক চর্চা। আর গণতান্ত্রিক চর্চা মানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিএনপি নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। কিন্তু আগামী নির্বাচনে দলটি বড় শক্তি নিয়ে রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে পারবে- এটাও কেউ মনে করছেন না। ফলে বিএনপি হচ্ছে একমাত্র বড় রাজনৈতিক দল। যদিও বিএনপির সঙ্গে যেসব দল শেখ হাসিনার সরকার পতন আন্দোলনে ছিল তাদের আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে নির্বাচন বিএনপি এককভাবেই করবে বলে মনে হয়।
দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপির সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা আছে এগুলোও বলছেন নেতারা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে এমনও আলোচনা রয়েছে- আওয়ামী লীগ বিগত তিন টার্ম নির্বাচনগুলো সঠিকভাবে দিলে এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণ না করলে তাদের এ রকম পরিণতি ভোগ করতে হতো না। মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতো না। সুতরাং দ্রুত জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং তাদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা- এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করে বিএনপি। তবে নির্বাচনের আগে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হোক, এটি বিএনপি চাইছে না। যে কারণে সব ধরনের সংঘাত এড়ানোর পক্ষে। পাশাপাশি দলকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার পক্ষে।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘অতীতের ভুলত্রুটি শোধরানোর জন্য বিএনপি নিয়মিত ক্লাস করছে। সেই পরীক্ষার ফলই হলো রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা। এই ৩১ দফায় নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যাতে তারা ৩১ দফার আলোকে নিজেদের তৈরি করতে পারেন এবং আগামী দিনে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে বিএনপিকে জনগণ আরও স্বচ্ছভাবে পাবে। জনগণের কাছে আরও বেশি দায়বদ্ধ থাকবে বিএনপি। আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ৩১ দফা বাস্তবায়ন করবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। ফলে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা আগামী দিনে কাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাবে। তিনি বলেন, বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু সংস্কারের কথা বলেছে। তারা কিছু সংস্কারও করবে। বাকি কাজ নির্বাচিত সরকার করবে। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করার আগে চার-পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্ট্যাডি করেছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, প্রয়োজনে আরও কিছু সংস্কার বা সংশোধন করা হবে। আগামী দিনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে পথচলা বিএনপির টার্গেট।
সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় ঘটে। এরপর থেকেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পরিচালনায় সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে বিএনপি। এই সরকারে সুশীল সমাজের পাশাপাশি ছাত্রদের অংশীদারত্ব রয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবিধান সংশোধনসহ চলমান সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন দেবে নাকি সবকিছু সংস্কার করে নির্বাচন দেবে, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।
গতকাল শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম বলেছেন, শুধু নির্বাচনের জন্য দুই হাজার মানুষ জীবন দেয়নি। অর্ধলাখ মানুষ রক্ত দেয়নি। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিস্টেমগুলোর যৌক্তিক সংস্কার করে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অতিদ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এক বছর নাকি আরও বেশি সময় লাগবে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের দাবিতে চাপ অব্যাহত রাখতে চায় দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেহেতু এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেই সেহেতু তারাই বড় দল। আজ বা কাল হোক নির্বাচন তো দিতে হবেই। বিএনপি নির্বাচনের দিন-তারিখ, বিশেষ করে রোডম্যাপের তাগিদ দেবে- এটা স্বাভাবিক বিষয়। তিনি মনে করেন, তারা ক্ষমতায় যেতেও প্রস্তুত। এ জন্য দলীয় শৃঙ্খলা যারা ভঙ্গ করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।