এ বছরের ডিসেম্বরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় বিএনপি। দলটির এই দাবির সঙ্গে একমত জাতীয় পার্টি ও বাম ঘরানার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মোট ৪৭টি দল।
অন্যদিকে ভোটের মাঠে বিএনপির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ১০টি দল ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষে নয়। তারা ডিসেম্বর থেকে সময়সীমা জুন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষের পাল্লাই ভারী। যদিও এই ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে একধরনের অস্থিরতা চলছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বাইরে চারটি দল সংস্কারের পরই নির্বাচন চায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া আলোচিত এই চারটি দল হলো- তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। তবে এই দলগুলোর তৎপরতা প্রায় নেই বললেই চলে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজকে নির্বাচনব্যবস্থা ধসে পড়েছে। এই নির্বাচনব্যবস্থা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ঠিক করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচন ডিসেম্বরে না হলেও জুনের মধ্যে হবে- তিনি এই কথাটা বলে সবাইকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। তবে আমি আশা করছি, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই সরকার ও নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের জনগণ ও নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন আমরা সেই সংস্কারটুকু চাই।’
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা দাবি করে আসছেন, নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম সংস্কারকাজ শেষ করতে আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের বেশি সময় লাগার কথা নয়। অনেক সংস্কার এই সরকার করতে পারবে না, সেগুলো নির্বাচিত সরকার এসে করবে।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবিতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে মিত্রদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে বিএনপি। এখন পর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দল ও জোটের সঙ্গে ঐকমত্য পৌঁছেছে। এর বাইরে ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচনের পক্ষে বুধবার (২৩ এপ্রিল) অবস্থান স্পস্ট করেছে সিপিবি ও বাসদ। এর আগে গত রবিবার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে চা-চক্রে এই দুই দলের নেতারা একই মত দেন।
সূত্রমতে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে বাম-ডানসহ সব রাজনৈতিক দলকে এক মঞ্চে আনতে তাদের সঙ্গেও বৈঠক করবে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় এবার জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ ইসলামপন্থি অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করবে দলটি। সব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সরকারকে বার্তা দেবে দলটি।
ডিসেম্বরে সম্মত নয় জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি
বিএনপির দাবি করা ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে না জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি। তারা বলছে, সরকার ঘোষিত নির্বাচনের ডেটলাইন এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন মাসের হলেও তাদের আপত্তি নেই। তবে একতরফা ভোট যাতে না হয় সে জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছে তারা। পাশাপাশি ডিসেম্বরেই ভোট দিতে হবে- সরকারকে এমন চাপ দিতে রাজি নয় এই দল তিনটি।
যদিও সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠকের পর জামায়াত বিএনপির দাবি করা সময়ের কাছাকাছি অবস্থান ব্যক্ত করেছিল। ডা. শফিকুর রহমান তখন জানিয়েছিলেন, রমজানের আগেই, অর্থাৎ আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন চান তারা। কিন্তু এখন আবার নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচার ও সঠিক নির্বাচন পদ্ধতি- এই তিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে জামায়াত। অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে আবারও দলটি একধরনের দ্বিমত প্রকাশ করেছে। যদিও দলটি এখনো তাদের নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক ফিরে পায়নি। আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলা ঝুলে আছে। নিবন্ধন ফিরে পেতে আইনি জটিলতা বাড়তে পারে, সে জন্য দলটি নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে চাপ দিতেও রাজি নয় বলে আলোচনা আছে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে, সরকারকে চাপ দিয়ে এটা আমরা বলব না। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন চেয়েছি। অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে হলে ভালো হবে। কারণ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রোজা হবে এবং জুনে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।’
এদিকে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন করে সংবিধান পুনর্লিখন ও জুলাই সনদ তৈরির পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় এনসিপি। এসব শর্ত পূরণ হলেই দলটি নির্বাচন অংশ নেবে। যদিও এনসিপি এখনো রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায়নি। দলটি নিবন্ধনের সময়সীমা তিন মাস বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই সনদ ও সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। এরপর নির্বাচন ডিসেম্বরে হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা সরকারকে ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে এমন কথা আমরা বলব না।’
রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়ে চাপ তৈরি করতে রাজি নয়। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হলেই তারা খুশি। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা বলে আসছি, আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। এই হিসাবে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হলে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এর আগেই মৌলিক বিষয়গুলোর সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে হবে।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন আলাদাভাবে চলতে পারে। সরকার আলাদা টাইমফ্রেম করে টার্গেট নিয়ে এগোলে ডিসেম্বরের সঙ্গে এক-দুই মাস এদিক-সেদিক করে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তবে সব দলের ঐকমত্য লাগবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে, এটা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর।’
তৃণমূল বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংস্কার, দলগুলোর সংস্কার, রাজনীতি প্রভাবমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি জনগণের মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার হওয়া জরুরি।
এছাড়া, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে।
ডিসেম্বরে ভোটের পক্ষে
বিএনপির মতোই ডিসেম্বরে ভোট আয়োজনের পক্ষে অনড় যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৪টি রাজনৈতিক দল। এগুলো হলো- লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), গণতন্ত্র মঞ্চের ৬ দল, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণঅধিকার পরিষদ, লেবার পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও গণফোরাম। এর বাইরে ১২টি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে ভোট চায়। দলগুলো হলো- জাতীয় পার্টি, সমমনা ইসলামপন্থি চার দল, সিপিবি ও বাসদের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট, আমার বাংলাদেশও (এবি) চলতি বছরেই নির্বাচন চায়।
১২-দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা দেখে সব দলই তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায়। ডিসেম্বরে ভোট দিলে সরকারের জন্যই ভালো হবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে তিনটি নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোট দিতে পারেননি। তাই দ্রুত নির্বাচন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি মনে করি, ডিসেম্বর কেন, চাইলে আরও দুই মাস আগে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরা মনে করি, অনির্বাচিত সরকারের বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা ঠিক হবে না। গণ-অভ্যুত্থান শুধু শেখ হাসিনাকে বিদায় করার জন্য হয়নি, বরং গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্যও হয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূস অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি, আমরা চাই ডিসেম্বরের মধ্যেই তিনি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবেন। ওনার প্রস্থান হবে ইতিহাসে নজিরবিহীন।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, “গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের মাঝে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা এই সরকার বা জাতীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা দরকার। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতভেদ রয়েছে। এটা স্বাভাবিক। তবে সবার মতামত নিয়েই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের প্রস্তাব ছিল সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য ডিসেম্বর থেকে জুন- এই সময়ের জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা।”
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ডিসেম্বরে মধ্যে ভোট হওয়াটাই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে সমমনা ইসলামপন্থি ৪টি রাজনৈতিক দল- খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম পার্টি। সমমনা ইসলামপন্থি দলের পক্ষ থেকে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে। আমরা প্রথমটা অর্থাৎ ডিসেম্বরকে ধরে নিয়েছি। তাই সংস্কার কাজ শেষ করেই ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া উচিত হবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বামজোটের অন্যতম নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সংস্কারের নামে কী কী করতে চান তা দলগুলোকে জানান। ভালো নির্বাচন করার জন্য যা যা সংস্কার করা দরকার তা করে নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা দিন। আমরা মনে করি, এটা ডিসেম্বরের অনেক আগেই করা সম্ভব। কোনোভাবেই এই বছর পার করা যাবে না। সম্ভব হলে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলে দেওয়া উচিত।’