দেশে অনলাইন হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের প্রবণতা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। ফেসবুকে কারও পোস্ট যদি মতাদর্শ বা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিপরীত হয়, সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিরূপ বা আক্রমণাত্মক মন্তব্য আসে। ফেসবুকে কারও কোনো একটা খুঁত খুঁজে পেলে রক্ষা নেই, শুরু করে দেওয়া হয় টানাহেঁচড়া। বিভিন্ন বয়সের মানুষ এ বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে বহু ট্রলের শিকার হওয়া শিশুশিল্পী সিমরিন লুবাবা এর বড় উদাহরণ। এ ধরনের অনলাইন হয়রানি বা বুলিংয়ের কারণে অনেকেরই মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি কখনো কখনো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বিশেষ করে অনলাইনে একে অপরকে ট্রল করা, কমেন্ট সেকশনে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা, ইনবক্সে নিপীড়ন করা, উসকানিমূলক তথ্য ছড়ানো, ব্যক্তিগত আক্রমণ ইত্যাদি বেড়ে চলেছে। এর কারণ হচ্ছে আমাদের সহনশীলতা কমে যাচ্ছে।
জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির (সিএসএ) মহাপরিচালক আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল সোমবার জানিয়েছেন, ফেসবুক, গুগলের মতো ডিজিটাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে প্রণয়ন করা হচ্ছে ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩।’ ইতোমধ্যে আইনটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন প্রযুক্তি নির্ভরশীল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিত্যনতুন আকর্ষণীয় ফিচারের মোহে ভার্চুয়াল জগৎই এখন মানুষের কাছে বাস্তব জগৎ। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিনোদন এবং যোগাযোগের মাধ্যম থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত হতাশা উদ্গীরণের জায়গা হয়ে যাচ্ছে না তো!
একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, ততই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীরা। আমাদের মধ্যে দিন দিন সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। আমাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, পারিবারিক অশান্তি, একাকিত্ব, সামাজিক রীতিনীতির সীমাবদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নসহ নানাবিধ কারণে আমরা দিনে দিনে নিষ্পেষিত হচ্ছি। আবার এই ক্ষোভ, এই হতাশা আমরা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি না। এমতাবস্থায় নিজেদের অগোচরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা সহিংস হয়ে উঠছি। আমাদের যত ক্ষোভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে বিস্ফোরিত হচ্ছে। আবার অনলাইনের এই বিস্ফোরণের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে আমাদের অফলাইন জীবনে পড়ছে।’
একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকর্মী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে ফেসবুক। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই যদি দেখি, বিগত কয়েক বছরে ফেসবুকে ছড়ানো মিথ্যা তথ্যের কারণে দেশে একাধিক বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো, পদ্মা সেতুতে শিশুর রক্ত আর মাথা লাগার গুজব ছড়ানোর পরিণতিতে ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকায় এক মাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা, ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে ভাঙচুর ও নির্যাতন। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা বা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এ রকম ভুরি ভুরি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর পেছনে অনেক রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এই সংবেদনশীল তথ্যগুলোর ফ্যাক্ট চেক না করে গণহারে শেয়ার করার কারণে যে অঘটনগুলো ঘটছে, এই কারণগুলোর নেপথ্যে কী থাকতে পারে! এর একটা কারণ হতে পারে এই সব উসকানিমূলক তথ্য শেয়ার করার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে একধরনের আত্মতুষ্টি কাজ করে। নানাবিধ সমস্যার মধ্যে জর্জরিত আমরা যখন অনলাইনে ঢুকে আমাদের বিশ্বাসের ভিন্নমতের কোনো বিষয় দেখি, তখন তার মধ্যে মনের রং মিশিয়ে আমরা তিলকে তাল বানিয়ে শেয়ার করি। এর ফলে একটা মানুষ যখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে, তখন আমাদের মধ্যে একধরনের প্রশান্তি কাজ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘আমাদের বাকস্বাধীনতা নেই। ফলে মানুষের ভেতর যে রাগ বা হতাশা অবদমিত হয়ে আছে, তা অন্য মানুষের ওপর উগরে দিচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান এমন কঠিন জায়গায় পৌঁছেছে, সব জিনিসের দাম যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ পেরে উঠতে পারছে না। মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। কিন্তু সবার হাতেই একটা করে মোবাইল ডিভাইস আছে, যার মাধ্যমে সে তার মতামত প্রকাশ করতে পারছে। এমতাবস্থায় জীবনের নানা পর্যায়ে মানুষের যে অভিযোগগুলো জমা হয়ে আছে, যার বিরুদ্ধে তারা কিছু বলতে পারছে না, এই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের অভিযোগটাকে অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর ঝেড়ে দিচ্ছে। আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতা অনেক বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো প্রকাশের জন্য সমাজে অনেকগুলো পাত্র তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে আপনি যদি নারী হন, উচ্চবিত্ত পরিবারের হন, কথাবার্তায় আঞ্চলিক টান থাকে তাহলে আপনি হবেন এসব হতাশা ঝাড়ার আদর্শ পাত্র। বিশেষ করে নারীঘটিত কোনো ইস্যু হলে মানুষের অভিযোগ স্থানান্তর করার ক্ষেত্রটা অনেক বেশি হারে হয়ে থাকে। একটা বাচ্চা মেয়েও এর থেকে রেহাই পায় না। আমাদের যেহেতু অনেক হতাশা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সবচাইতে দুর্বল যে সামাজিক শ্রেণি তার ওপরেই এই ব্লেইম ট্রান্সফার করা হচ্ছে। আমাদের অনলাইন স্পেসে ডেমোক্রেটিক স্পেস নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে কথা বলা দরকার, সে সুযোগ নেই বলেই হয়তো অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন বা ক্ষমতাহীন জায়গায় আমাদের রাগ প্রকাশ করে ভেতরের দহন কম করি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকি এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের কারিকুলাম, রাষ্ট্রের গুরুত্বহীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা মিলিয়ে এই অবস্থার জন্য দায়ী আমরা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যেখানে মানুষ মূল্যবোধের জায়গাটাকে অনেক বড় করে দেখে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে মিডল ইস্ট, আফ্রিকা বা সাউথ এশিয়ায় মূল্যবোধের জায়গাটিকে অনেক কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশে একটি ভালো প্রজন্ম তৈর করার জন্য উদ্যোগ বা আগ্রহ রাষ্ট্রের কোনো লেভেল থেকে কখনো দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্র তার নিজের সুযোগ-সুবিধা নিয়েই সব সময় ব্যস্ত থাকে। এর ফলে শিক্ষা, মূল্যবোধ এইগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে সামাজিকীকরণ করা হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ভালো-মন্দের বিভেদ শেখানোর ওপর জোর দেওয়া হয় না। ফলে যার যা ভালো লাগছে সে তাই করছে, এতে কাউকে আঘাত দেওয়া হচ্ছে কি না এসব কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। দিন দিন ভালো চিন্তাশীল মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকি বলেন, ‘মডার্ন কমিউনিকেশন, যাকে আমরা নিউ মিডিয়া বলি এর মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগটা হয়ে যাচ্ছে অবারিত। এই মুহূর্তে কিছু দেখছেন, তার ওপর ভিত্তি করে নগদে কোনো মন্তব্য করে বসলেন। এভাবে মন্তব্য করার জন্য ব্যক্তির মধ্যে একধরনের হিরোইজম কাজ করে। এই ভালো লাগা থেকে একধরনের স্যাডিজম তৈরি হয়, যা তাদের আনন্দ দেয়, একে তারা গুরুত্ব দেয়। ফলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে মানুষ পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে, তাদের মধ্যে স্যাডিস্ট আনন্দের দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়া মানুষ পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে, তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষোভ তারা তাদের কাছের মানুষদের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারছে না, তাই ফেসবুকে অপরিচিতদের উপরে উগড়ে দিচ্ছে।