
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একধরনের সংকট চলছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় শিক্ষাক্ষেত্রে যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল, তার জের এখনো কাটেনি। উপরন্তু পাঠ্যপুস্তকের অভাবে শিক্ষায় ছন্দপতন ঘটে গেছে। এই চিত্র প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের। এই সংকটের চিত্র উঠে এসেছে খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
প্রধানত দুই কারণে শিক্ষায় সংকট দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক শিক্ষাসূচির অংশ হিসেবে গত জানুয়ারিতে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় মাসেও সরকার সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দিতে পারেনি। দ্বিতীয় সংকটটা দেখা দিয়েছে দীর্ঘদিনের জন্য বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যাওয়ার কারণে। রোজা-ঈদ দিবস উৎসব মিলিয়ে ৩৮ দিনের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পাঠ্যবইয়ের অভাবে এই ছুটির দিনগুলোও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিহীন অবস্থায় কাটছে। ছুটির দিনগুলোতে নিজেদের পঠনপাঠনকে এগিয়ে নেওয়ার যে লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের থাকতে পারত, এখন সে সুযোগ তারা পাচ্ছে না। পাঠ্যবইয়ের অপ্রাপ্তি সংকটের উৎস হয়ে আছে।
বছরের প্রথম দিনেই সরকার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করে থাকে। প্রায় এক দশক ধরে এই রীতি চলে আসছে। কিন্তু এবারই তাতে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটেছে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাঠ্যবই পরিমার্জনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই পরিমার্জনায় কালক্ষেপণ এবং অন্য কিছু সমস্যার কারণে যথাসময়ে বই ছাপা সম্ভব হয়নি। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। শিক্ষাবর্ষের দুই মাস পেরিয়ে তৃতীয় মাস শুরু হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৬ কোটি ৩৮ লাখের বেশি বই সরবরাহই করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এ নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টাসহ এনসিটিবিকে অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। অভিভাবক ঐক্য ফোরাম ও জাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি আন্দোলন নামে অভিভাবকদের দুটি সংগঠন অবিলম্বে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে সব পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। সংগঠনটির নেতারা ছুটির মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিষ্ক্রিয় থাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাসময়ে বই সরবরাহ না করায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্লাস শুরুর দিন থেকে বই না পাওয়ায় তারা হতাশ। লম্বা ছুটিতে সরাসরি সম্ভব না হলেও অনলাইনে ক্লাস চালুর দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
নিঃসন্দেহে অভিভাবকদের এই উদ্বেগ ও দাবি যৌক্তিক। পাঠ্যবই না পেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্থবিরতা দেখা দেয়। শিখন ঘাটতি ঘটে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার)। এতদিন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ এই দায়িত্ব পালন করছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সি আর আবরার এককভাবে দায়িত্ব পাওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজে আরও গতির সঞ্চার হবে বলে আমরা আশা করছি। প্রথমেই তার কাজ হবে, আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, পাঠ্যবইসংকটের সমাধান করা। নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের মুহূর্তে বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, ১০ মার্চের মধ্যে শিক্ষার্থীরা অবশিষ্ট বইগুলো পেয়ে যাবে। একই কথা বলেছেন পাঠ্যবই সরবরাহের দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির এক কর্মকর্তা। তিনি বলেছেন, কাগজের সংকটের কারণে বই ছাপা যায়নি। ৫ মার্চ বুধবারের (গতকাল) মধ্যে সব বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তবে এনসিটিবির সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে একজন মুদ্রণকারী বলেছেন, কাগজসংকটের কারণে ১০ মার্চও সব বই দেওয়া সম্ভব হবে না।
বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও এনসিটিবি যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিতে পারেনি। এবারও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনে এগিয়ে আসবেন।
অভিভাবকরা যে দাবি জানিয়েছেন, দীর্ঘ ছুটির মধ্যে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া যায় কি না, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেবে দেখতে পারে। তবে গ্রাম-শহর-নগর মিলিয়ে সব শিক্ষার্থী যদি অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ না পায়, তাহলে সে রকম উদ্যোগ গ্রহণ না করাই হবে যুক্তিযুক্ত। ইতোমধ্যে অবশিষ্ট পাঠ্যবই ছাপা হয়ে গেলে ছুটির মধ্যে বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সেগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলে তাদের হতাশা দূর হবে বলে আমরা মনে করি। সরকার সেই ব্যবস্থা করলে ছুটির মধ্যে শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও পাঠ্যবইয়ের সান্নিধ্যে কাটাতে পারে। এতে তাদের ছুটিটাও বর্ণিল হয়ে উঠবে।