
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যম ও ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতারকদের ফাঁদ থেকে বিত্তশালী, সহজ-সরল, গরিব-দুঃখী মানুষ কেউই বাদ যাচ্ছে না। পেশাদার প্রতারকদের মোহনীয়-লোভনীয় কথার জাদুতে ফাঁদে পড়ে কষ্টার্জিত অর্থসম্পদ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সহজ-সরল মানুষ। অল্প বিনিয়োগে বড় মুনাফা বা সুদের লোভ দেখিয়ে প্রতারণা, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতারণা, ই-ভ্যালি এবং ই-অরেঞ্জের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে সমাজে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতারণামূলক অপরাধ ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন অ্যাপস, ওয়েবসাইট, কথিত হটলাইন বা মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ধরনের প্রতারণার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত ‘সিস্টেমের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজে বিচিত্র ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটে থাকে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে ধরনও বদলেছে। অনেকেই প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা টার্গেট করে একশ্রেণির মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকেন। এখানে ভুক্তভোগীদেরও কিছু দায় আছে। এসব প্রতারণার শিকার হওয়া অনেক মানুষ এখন নিঃস্ব হলেও অপরাধীদের তেমন কোনো শাস্তি হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, থানায় প্রতারণার অভিযোগে কোনো মামলা হলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রতারণার ঘটনায় আইনের দুটি ধারায় দুর্বল সাজার ব্যবস্থা থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পেশাদার প্রতারকরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের ভাষ্যমতে, প্রতারণাসংক্রান্ত বিষয়ে পেনাল কোডের ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রতারণার যে ধরন ও ভয়ানক রূপ সমাজে দেখা যাচ্ছে, সে অনুসারে ওই দুটি ধারা খুবই দুর্বল। বিশেষ করে আর্থিক বা সম্পদকেন্দ্রিক প্রতারণার ক্ষেত্রে পেনাল বোডের ৪০৬ ও ৪২০ ধারাকে পেশাদার অপরাধীরা খুব একটা পাত্তা দেয় না। কারণ বিপুল টাকা বা সম্পদ হাতিয়ে নিলেও সাজা কম। অনেক সময় পুলিশ বাড়তি হিসেবে ‘মানি লন্ডারিং’ আইনের ধারাও যুক্ত করে থাকে। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা কঠিন। সব মিলিয়ে প্রতারণার আইনের ধারা দুটির সংশোধন এখন অতি জরুরি ও সময়ের দাবি।
সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রতারকরা তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য চটকদার নানা কথাবার্তা, প্রলোভন দিয়ে থাকে। অনেকে লোভে পড়ে প্রতারকদের কথা আস্থায় নিয়ে পরে বিপদগ্রস্ত হন। এ ক্ষেত্রে সমাজে দারিদ্র্যও একটি কারণ। অনেকে দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার লোভ থেকেও প্রতারণা করে থাকে। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। কোনো কিছুতে যুক্ত হওয়ার আগে সে বিষয়ে ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োগ হলে প্রতারণার হার অনেক কমে আসবে।’
অভিনব প্রতারণার ফাঁদে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। যেকোনো প্রস্তাব ভালোভাবে যাচাই করার ক্ষমতা অনেকের থাকে না। এ বিষয়ে জনসচেতনতাও কম। এ ছাড়া প্রতারকদের শাস্তির জন্য আইনি ধারাও দুর্বল। এ সুযোগ নিয়ে থাকে অপরাধীরা। তাই আইনের দুটি ধারা শক্তিশালী করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রতিটি অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।