
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ধর্ষণসহ নানা অপরাধ। ছিনতাইকারী নানা স্থানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি উন্নতির জন্য পুলিশ দিন-রাত পরিশ্রম করলেও আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। অভিভাবক মহল চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছে তাদের শিশুসন্তানদের নিয়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশু ধর্ষণের সংবাদে আতঙ্কিত রয়েছে তারা। মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনাটি দেশে এই মুহূর্তে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা মানুষের মনোজগৎকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিচ্ছে।
বিশেষ করে মানুষের মধ্যে কেন ‘বিকৃত রুচি ও মনোবৈকল্য’ সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনা চলছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের সীতাকুণ্ড, কুমিল্লা, রাজবাড়ী, ঠাকুরগাঁওয়েও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় চোর ও ছিনতাইকারী সন্দেহে আটজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাই এসব ঘটনার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শুরু হয়েছে সোচ্চার আন্দোলন। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নিপীড়নের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। আকস্মিকভাবে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এবং সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদ শুরু হওয়ায় সরকারও নড়েচড়ে বসেছে।
এদিকে সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলমান রয়েছে। এর পরও দেশজুড়ে হত্যাকাণ্ড, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গণপিটুনি বা মব ভায়োলেন্স প্রায় সব স্থানেই চলছে। পাশাপাশি চলছে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান। তবু যেন থেমে নেই অপরাধীরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীরা কাউকেই তোয়াক্কা করছে না। বরং দিনে দিনে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ঈদের সময় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে বাসাবাড়ি, দোকানপাটসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিজ দায়িত্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ঘটনায় জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের গত সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। পুলিশের সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলায় ২২৬টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৭০টি বড় ধরনের ঘটনা জনমনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি।
দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে পুলিশকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের আরও বেশি জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। আইন প্রয়োগের বিষয়টি জোরালো হচ্ছে না বলেই নানাভাবে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। এতে পেশাদার অপরাধীরা যেমন সুযোগ নিচ্ছে, আবার ব্যক্তিগত লোভ-লালসা থেকে যে অপরাধ সৃষ্টি হয় সেটিও হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন পরিপূর্ণভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে পারছে না, তখনই অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং দেশের ভেতরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের এক ধরনের সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে। পুলিশের মনোবল চাঙা করা, কাউন্সেলিং অথবা মোটিভেশনের মাধ্যমে পুলিশকে আরও গতিশীল ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। অনেক সময় পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজেরাই শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনেক পুলিশ পরিদর্শক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পান না। যার ফলে অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যায়।
দেশের বর্তমান সংকট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অন্তর্বর্তী সরকার এই মুহূর্তে আরও উদ্যোগী হবে, এটাই প্রত্যাশা।