
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যেসব নাগরিক সেবা দিয়ে থাকে, সেই সেবাদান প্রক্রিয়ায় চলছে স্থবিরতা ও নৈরাজ্য। এই নগরের ওয়ার্ডের সংখ্যা উত্তরে ৫৪ আর দক্ষিণে ৭৫। আগে এই সেবা পাওয়া যেত স্ব স্ব কাউন্সিলরদের মাধ্যমে। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই সেবা-প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটছে। সরকার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সঙ্গে কাউন্সিলরদের অপসারণ করে। সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের ভোগান্তির শুরু তখন থেকে।
সিটি করপোরেশন ১৪ ধরনের নাগরিক সেবা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন। এ ছাড়া নাগরিক, চারিত্রিক, উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশ), আয়, অবিবাহিত, দ্বিতীয় বিয়ে, পারিবারিক সমস্যা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদও দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যয়ন, অনাপত্তিপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকার যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর দিতে হতো কাউন্সিলরদের। এর বাইরে নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মশক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের তদারকির কাজও পরিচালিত হতো কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে। বর্তমানে এর সবকিছুই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নাগরিক সেবা প্রাপ্তির স্থবিরতার এই ছবিই উঠে এসেছে।
উল্লিখিত কাজগুলোর সঙ্গে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত ছিলেন স্ব স্ব ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের জানাশোনা ছিল। তিনি সনদ বা নাগরিক সেবার বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে সনদে স্বাক্ষর করতেন। কিন্তু মেয়র ও কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতির কারণে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী।
ওয়ার্ডগুলোর অফিস কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। সাত-আটটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠন করা হয়েছে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস। এই নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরেই মিলছে সনদ। কিন্তু একাধিক কাউন্সিলরের দায়িত্ব একজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে পালন করতে হচ্ছে বলে সেবা দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের অন্য কর্মকর্তারা কয়েক ধাপে সেবাপ্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে পড়েছে। সেবাপ্রার্থীদেরও বেড়েছে ভোগান্তি।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, জন্ম-মৃত্যু ও নাগরিকত্ব সনদ পাওয়া এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। নানা ধাপ পেরিয়ে একটি জন্মসনদ নিতে ১০-১২ দিনেরও বেশি সময় লেগে যায়। আগে শুধু একটি নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর সনদগুলোতে স্বাক্ষর করতেন। এখন স্বাক্ষর করছেন তিনজন- প্রথম ধাপে যাচাইকারী কর্মকর্তা, দ্বিতীয় ধাপে পরীক্ষক ও তৃতীয় ধাপে প্রধান আঞ্চলিক কর্মকর্তা। ফলে সময় লাগছে বেশি। বাড়ছে সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি। খবরের কাগজের প্রতিবেদকের কাছে এই ভোগান্তি নিয়ে সেবা নিতে আসা নাগরিকরা অভিযোগ করেছেন।
আমরা একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। কিন্তু এ জন্য নগরের সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের কোনো ধরনের ভোগান্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বড় সমস্যা হচ্ছে সময়ক্ষেপণ। বোঝাই যায়, লোকবলের অভাবেই সেবা পেতে নাগরিকদের সময় লাগছে। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই লোকবলের সংকট- সাময়িকভাবে হলেও দূর করে- নাগরিক সেবা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করা।
ওয়ার্ডগুলোর অফিসগুলোতে অনেক সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পাওয়া যায় না, বন্ধ থাকে, নাগরিকরা এই অভিযোগও করছেন। প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই সমস্যাও দূর করা সম্ভব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেবাপ্রার্থীরা জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত সনদ পাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। ফলে জরুরি ভিত্তিতেই তাদের সেবা দেওয়া প্রয়োজন। আমরা যেন ভুলে না যাই, এই নগরীর প্রত্যেক বাসিন্দা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য কর দিয়ে থাকেন। নাগরিক সেবা পাওয়া তাদের অধিকার। সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে তাদের সেবা দেওয়া। যথাসময়ে কোনো রকমের হয়রানি ছাড়াই তা হওয়া বাঞ্ছনীয়। সিটি করপোরেশনের এই কথাটি মনে রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকারেরও বিষয়টির প্রতি নজর থাকতে হবে। আমরা আশা করব, তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নাগরিক সেবা পাওয়াকে সহজ ও দ্রুততর করার চেষ্টা করবে।