
বাংলাদেশে শিক্ষার নানা স্তরে নৈরাজ্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। নতুন করে এতে যুক্ত হয়েছে সাত কলেজকেন্দ্রিক সংকট। এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেছেন। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর বিক্ষোভ-অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে তারা রাজপথে নেমে এসেছেন। এতে পুরো ঢাকা মহানগরী যান চলাচলের দিক থেকে অচল হয়ে যায়। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। কলেজগুলোর এই আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গত ১৬ মার্চ সাত কলেজকে নিয়ে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব দিয়েছে।
সরকারের এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় করার যে দাবি ছিল, আপাতত তার সুরাহা হলো। তবে শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেই হবে না, যে লক্ষ্যে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে।এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের একটা কথা স্মরণ করছি। তিনি বলেছিলেন, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও চরিত্র গঠনের সঙ্গে সঙ্গে একজন শিক্ষার্থী যাতে গভীর ও সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে শেখে, সেটাই হচ্ছে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য। উচ্চশিক্ষা তাই শুধু জ্ঞান অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। পরিপূর্ণ বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলে। এখন কথা হলো, নতুন যে এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে তার প্রয়োজন কতটুকু?
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে গতকাল খবরের কাগজে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৬টি; এখন সেই সংখ্যা ৫৫। এর বাইরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেছেন, উচ্চশিক্ষার প্রধান সমস্যা হচ্ছে শিক্ষক সমস্যা।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত মানসম্পন্ন শিক্ষার ওপর, নতুন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওপর নয়। বৈশ্বিক মানদণ্ডের দিক থেকেও দেখা যাচ্ছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান তলানিতে। কিউএস র্যাঙ্কিং ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিং-এ ৫০০-এর মধ্যে, এমনকি এশিয়ার ১০০-এর মধ্যেও নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার বৈশ্বিক নানা সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ফলে মান বৃদ্ধির ওপর শিক্ষাবিদরা গত প্রায় দুই দশক ধরে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে আসছেন। তাদের কথায়, সংখ্যা বৃদ্ধি যেটুকু হওয়া প্রয়োজন সেটুকু হয়ে গেছে। বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। কিন্তু মান বজায় রাখা যায়নি, ক্রমশ তা নিম্নমুখী হয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এ জন্য প্রথমেই যা করা দরকার তা হচ্ছে, বর্তমানে যেসব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেই সব প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। মানসম্পন্ন ডিগ্রিধারী দক্ষ শিক্ষকের সংকট দূর করতে হবে। অবহেলিত গবেষণার খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করাও জরুরি। এ ছাড়া শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বলা হবে বিশ্ববিদ্যালয়, অথচ সেই প্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকবে; তারও কোনো একাডেমিক যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে শুধু গ্র্যাজুয়েশন, মাস্টার্স ও উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকাই বাঞ্ছনীয়। মিশ্র ব্যবস্থায় একবার একজন শিক্ষক শিক্ষার একেবারে উঁচু স্তরে পড়াবেন, আবার তিনি নেমে আসবেন অনেক নিচু স্তরে; এভাবে শিক্ষাদান করাটা বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
আমরাও মনে করি, ইতোমধ্যে যেসব সরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স চালু রয়েছে, সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উল্লিখিত সংকটগুলো আগে দূর করা প্রয়োজন। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যদি সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হয়, তাহলে তা দোষের নয়। সাত কলেজে অনেক শিক্ষার্থী। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক, যাতে আগামীতে শিক্ষার্থীদের আর মাঠে নামতে না হয়। সরকারের এই উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।