
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ অনেকটাই দিশেহারা। কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনীতি মন্থর হয়ে আছে। অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থায় কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন, কেউ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শেয়ার লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আড়াই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান রয়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এত সমস্যার মধ্যেও আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে এখন বিপুল অর্থ। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে ভয়াবহভাবে। এতে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। সম্প্রতি বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। এটি আশার কথা। জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
স্বল্প আয় ও দরিদ্র মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার চাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু শুল্ক কমালেও দাম কমেনি বরং আরও বেড়েছে। শুল্ককরের সুবিধাও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে চলে গেছে। খেজুর, সয়াবিন তেলসহ সব পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানির পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এনবিআরের সাবেক সদস্যের মতে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, শুল্ককর কমিয়ে বাজার স্থিতিশীল করা যায়নি। বরং মাঝখান থেকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। সে জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে তদারকিব্যবস্থা আরও জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখে ব্যাংকে, তারপর নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। কিন্তু সুদ বেশি হওয়ার পরও সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। এমনকি সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার প্রবণতাও লক্ষণীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ২৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙেছেন গ্রাহকরা। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্র কেনার হার ২৭ শতাংশ কমেছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া ও ভাঙার হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়েছে। সেই হারে আয় বাড়ছে না, সে জন্য অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া দেশের রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সবকিছু একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই। বিনিয়োগের পরিবেশও তেমনটা আশাব্যঞ্জক নয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহ হারাচ্ছেন দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে। এ অবস্থায় দেশে কর্মসংস্থানেও ভাটা পড়েছে, এর ফলে আয়ও বাড়ছে না।
সাবেক সচিব গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ৭-৮ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু আমি মনে করি, আগামী এক বছরের মধ্যে ওই পর্যায়ে কমার সম্ভাবনা নেই। উৎপাদনব্যবস্থায় এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, আমাদের উচিত ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করা। যাতে কেউ ইচ্ছা করলেও দাম বাড়াতে না পারে।’
গত কয়েক বছরে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এরই মধ্যে দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। গত সরকারও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর ফল হিসেবে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি আগের তুলনায় কমেছে। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার কিছু কিছু পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ বাড়িয়েছে, তার পরও রোজায় সেসব পণ্য ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। যদিও এ ক্ষেত্রে শুল্ককর অব্যাহতি দেওয়ায় পুরো মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের কবজায় রয়েছে। এ অবস্থায় বাজার তদারকিব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।