
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। সবাই গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সাহরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় একের পর শুরু হয় বোমা হামলা। চারদিকে আতঙ্ক আর রক্তাক্ত মানুষের আর্তচিৎকার, ছোটাছুটি। গাজা উপত্যকায় আবার রক্ত ঝরল।
গত সোমবারের ঘটনা এটি। খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ওই দিন মধ্যরাতের পর আকস্মিকভাবে শুরু হয় এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। গাজার দক্ষিণের খান ইউনিস ও রাফা, উত্তরের গাজা নগর এবং মধ্যাঞ্চলের দেইর আর-বালাসহ গাজার প্রায় সব জায়গায় ইসরায়েল কুড়িটিরও বেশি যুদ্ধবিমান ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালায়। এক রাতেই প্রাণ হারান ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে ছিলেন নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। আহত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ শর মতো মানুষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পুরো পরিবার। ইসরায়েলি আক্রমণে ২৩ লাখ জনবসতিপূর্ণ গাজা এভাবেই পরিণত হয় বিপজ্জনক রণক্ষেত্রে। ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ গাজার হামাস বলেছে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে এই বর্বরতম হামলা চালিয়ে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে। ইসরায়েল অবশ্য বলেছে তারা চুক্তি ভঙ্গ করেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরায়েল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
প্রায় ১৫ মাস ধরে গাজার ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর গত ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২ মার্চ। মূল চুক্তিতে বলা ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে। যদি এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হয়, তাহলে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলবে। এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিম্মিবিষয়ক দূত অ্যাডাম বোয়েহলারও একটি সমঝোতা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, হামাস ইসরায়েলি-আমেরিকান জিম্মি মুক্তি দেবে এবং চারটি লাশ ফেরত দেবে। হামাস এতে রাজি হয়েছিল। তারা ধরে নিয়েছিল এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে। কিন্তু ইসরায়েল বোয়েহলারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। নতুন করে তারা দ্বিতীয় ধাপের চুক্তি করেনি আর প্রথম ধাপের চুক্তি ভঙ্গ করে গাজায় আক্রমণ চালিয়েছে। হামলা চালানোর আগে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ইসরায়েল অনুমতিও নিয়েছে। এই হামলার দায় তাই ওয়াশিংটনেরও।
আমরা মনে করি, ইসরায়েল যা করেছে তা জঘন্যতম অপরাধ। তারা রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। শুধু এবারই নয়, দিনের পর দিন দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী এটি করে আসছে। শুধু গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৫৭৭ জন ফিলিস্তিনি তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ হাজার ৫০০ ছিল শিশু। এসব হত্যা নিঃসন্দেহে মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। ইসরায়েলের এই বর্বরোচিত আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে পৃথিবীর বহু দেশ। আগেও বিশ্ববাসী ছিল এর বিরুদ্ধে সোচ্চার।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রে দিনের পর দিন প্রতিবাদী মিছিল ও সমাবেশ করেছে সে দেশের বিবেকবান সচেতন মানুষ। নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারসহ দেশের সাধারণ মানুষ। এবারও আমরা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। নিন্দা জানাই ইসরায়েলের। শুধু নিন্দা নয়, বিশ্ববাসী ও জাতিসংঘকে জরুরি ভিত্তিতে এই হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সেই প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে যা করণীয় তা হলো, অবিলম্বে হামলা বন্ধ করে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে হবে। তবে এ সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। বহু বছর ধরে সেই চেষ্টা চলছে, কিন্তু সফলতা আসেনি। এখন আবার সেই উদ্যোগ গ্রহণ করাটা সময়ের দাবি। জাতিসংঘের উদ্যোগে সেটি হতে পারে। পরাশক্তিসহ উভয় পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে জাতিসংঘ সমস্যা সমাধানের গ্রহণযোগ্য একটা উপায় বের করতে পারে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই, কোনো অবস্থাতেই গাজায় যাতে আর একবিন্দু রক্ত না ঝরে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।