
দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা এখন চরমে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ছিনতাই ও চুরির ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে গত রবিবার ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এ সময় তারা নারী, শিশুসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন। কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধ করতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়।
সেখানে বক্তারা বলেন, দেশব্যাপী ছিনতাই, হামলা, ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উদ্দেশে তারা বলেন, দেশের মানুষকে সুরক্ষা দিতে না পারলে পদত্যাগ করুন। এদিকে গত রবিবার দিবাগত রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রেস ব্রিফিং করেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ডেভিল হান্ট’-এর মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাসীদের কোথাও কোনো স্থান হবে না। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। সরকারের উপদেষ্টারাও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে পরিস্থিতি উত্তরণে নানা পদক্ষেপের কথা বলছেন। এ বিষয়ে গত সোমবার বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের উপদেষ্টা, সচিব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতনদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, টাঙ্গাইলে রাজশাহী রুটের একটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি করার ঘটনা ঘটে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া উত্তরা ও মগবাজারে গত সপ্তাহে প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ছিনতাইকারী সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। বনশ্রীর ৭ নম্বর রোডের ডি ব্লকে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ লুটের ঘটনা ঘটে। যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন শোরগোল ফেলে দিয়েছে। এসব ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম জানিয়েছেন, ছিনতাই প্রতিরোধে শিগগিরই মাঠে নামবে পুলিশের বিশেষায়িত তিনটি ইউনিট। দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলমান। ঠিক সেই সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য অপরাধীরা উঠেপড়ে লেগেছে। যা খুবই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ৩৯ জন নারী-শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া গত বছরে তথা ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪০১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জুলাই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়। সেই অস্ত্রগুলোর মধ্যে এখনো বেহাত ১৩ শতাধিক অস্ত্র। এসব অস্ত্র এখন পেশাদার অপরাধীদের হাতে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ডিসি সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন। এরপরও থামছে না অপরাধ প্রবণতা।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাড়া বা মহল্লায় জনসচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ হঠাৎ করে চরম অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। গত কয়েক দিনে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যদিও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অপরাধের তথ্য উঠে আসছে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি যাতে আরও অসহনীয় না হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। আশা করছি, সরকারও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।