মিউনিখের আকাশে আলো ছড়াচ্ছে আইফেল টাওয়ারের পাঁচটি ঝলমলে আলোকচ্ছটা। আনন্দ উৎসবে উন্মাতাল একদল তরুণ। ইউরোপ-সেরার আসরে এতটা দাপট নিয়ে এর আগে কেউ চূড়ায় উঠেছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তবে পিএসজির এই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে নিজ মহিমা আর অনন্য গৌরবে।
১৪ বছর আগে কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট যখন পিএসজি ক্লাবটি কিনে নেয়, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল স্বপ্নের বীজ বোনা। সে বীজে জল দেওয়ার মতো ঢালা হয়েছিল কাঁড়ি কাঁড়ি পেট্রো ডলার। মেসি, নেইমার, এমবাপ্পের মতো তারকাদের এনে পিএসজিকে পরিণত করা হয়েছিল তারার হাটে। কিন্তু রুপালি ট্রফি আর স্পর্শ করা হয়নি। অধরাই থেকে গিয়েছিল। ফুটবলবিশ্ব তাই ধরে নিয়েছিল- পিএসজির ভাগ্যে বোধ হয় লেখা নেই ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ’।
কিন্তু ফুটবল এমন এক খেলা যেখানে সব ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা পায় না। আজ যে আকাশে তারা নেই, কালই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের দেখা মেলে সেখানে। সেই রকমই এক রূপকথার রাত এল প্যারিসের ক্লাবটির। পাঁচবার আলোকিত হলো আইফেল টাওয়ার, মিউনিখের অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ঠিক যতবার ইন্টার মিলানের জালে বল পাঠিয়েছে। পিএসজি জয়ী ৫-০ ব্যবধানে।
৫৪ বছরের ইতিহাসে এই জয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরা পিএসজি। শুধু জিতেই না, ইউরোপিয়ান কাপে প্রথমবার কোনো দল ফাইনালে পাঁচ গোল করে জিতল। করল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়ও। একই সঙ্গে ট্রেবলও নিশ্চিত হলো দলটির। লিগ ওয়ান, ফরাসি কাপ আর ইউরোপ-সেরা হওয়ার স্বপ্ন; তিন সত্যি একই মৌসুমে।
ট্রেবল জয়ের স্থপতি স্প্যানিশ কোচ লুইস এনরিকে। ২০১৫ সালে বার্সার হয়ে ট্রেবল জেতা এনরিকে নিজের জীবনেও পেলেন অনন্য এক স্বস্তির রাত। ৯ বছর আগে ক্যানসারে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া কন্যা জানাকে উৎসর্গ করলেন এই জয়। পিএসজিকে এনে দিলেন সেই সোনালি বিকেল, যার জন্য ক্লাবটি অপেক্ষা করেছিল বছরের পর বছর। একটা সময়ে পিএসজি ছিল তারায় তারায় জ্বলজ্বলে। ছিলেন মেসি, নেইমার ও এমবাপ্পে। কিন্তু তখন হয়নি। যখন হলো তখন পিএসজি তারুণ্যে দীপ্তময় এক দল।
অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারিনায় ১২ মিনিটে প্রথম গোল আশরাফ হাকিমির। একটা সময় যিনি ছিলেন ইন্টারেরই খেলোয়াড়। ২০ ও ৬৩ মিনিটে জোড়া গোল করে লাইমলাইটে ১৯ বছর বয়সী দেজিরে দুয়ে। তখনই মিউনিখে আগাম উৎসবের সুর। ৭৩ মিনিটে খিচা কাভারেস্কাইয়া এবং ৮৬ মিনিটে মাইয়ুলুর গোল উৎসবের রং বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ।
ইন্টার মিলানের এই হার কেবল হারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা একপেশে ধ্বংস। প্রথমার্ধেই দুই গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা। বিরতির পর যেন আর খেলতেই নামেনি সিমোনে ইনজাগির দল। দ্বিতীয়ার্ধে একটি শটও নিতে পারেনি তারা। গোলের সুযোগ মাত্র দুটি, তাও প্রথমার্ধে। যেখানে পিএসজি মাত্র প্রথমার্ধেই ১৩টি শট নেয়!
ধারাভাষ্যকারেরা বলেছিলেন, ‘মেন ভার্সেস বয়েজ’। শেষ বাঁশি বাজার পর বোঝা গেল, বয়সের পরিসংখ্যান নয়, ম্যাচ জেতায় সাহস, গতি আর কৌশল। পিএসজির ‘বয়েজ’রাই প্রকৃত যোদ্ধা। ইন্টারের গর্বের নীল সাপ হয়ে উঠেছে বিষহীন ঢোঁড়া, আর পিএসজির নাইটরা জিতে নিয়েছে রক্তমাংসের বীরের সম্মান।
দেজিরে দুয়ের নামটা আলাদা করে উচ্চারণ করতেই হয়। ১৯৬২ সালে ইউসেবিওর পর তিনিই প্রথম ‘টিনএজার’, যিনি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে জোড়া গোল করলেন। এই কীর্তি প্যারিসের ইতিহাসে রূপকথা হয়ে থাকবে বহু বছর।
আরেকটা প্রতিশোধও হলো এই জয়ে। ২০২০ সালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে যাওয়া সেই ফাইনাল- যা ছিল পিএসজির দুঃস্বপ্ন। এবার সেই বায়ার্নের ঘরের মাঠেই রচিত হলো বিজয়ের মহাকাব্য। সব মিলিয়ে পিএসজির জন্য এ রাত ছিল মুক্তির, পরিশ্রমের স্বীকৃতির, দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান।
অনেক সময় ক্লাবের আকাশে তারকার ঝলকানি থাকলেও নিচে বিরাজ করে শূন্যতা। পিএসজি সে পথে না হেঁটে এবার বেছে নিয়েছিল ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তারকা নয়, তরুণদের গড়ে তোলার রাস্তায় হেঁটেছিল তারা। ফল? অপ্রতিরোধ্য এক পিএসজি। রোমাঞ্চে ভরা ফুটবল, চোখ ধাঁধানো পাস, ইউরোপ সেরার গর্ব।
আশরাফ হাকিমির গলায় সেই অহংকারের সুর, ‘আমরা ইতিহাস গড়েছি। ক্লাবের প্রাপ্য জেতা আমাদের খুব খুশির।’ ক্লাব মালিক নাসের আল খেলাইফির চোখেমুখে আত্মতৃপ্তি, শেষ বাঁশি বাজার পর চওড়া হাসি যেন বলে দিল, ‘দেখেছ তো? আমরা পেরেছি!’